Saturday 28 October 2017

কেন বিদেশি বর্বর তুর্কিরা ধ্বংস করেছিল নালন্দা মহাবিদ্যালয়কে??

ওয়েবডেস্কঃ- পাল শাসনকালে বৌদ্ধধর্মের প্রথাগত মহাযান ও হীনযান সম্প্রদায়ে গোপন আচার-অনুষ্ঠান ও জাদুবিদ্যা-কেন্দ্রিক তান্ত্রিক ক্রিয়াকর্ম অন্তর্ভুক্ত হয়। ভারতীয় উপমহাদেশে বৈষ্ণব ও শৈব দার্শনিকদের আবির্ভাব এবং ১১শ শতাব্দীতে বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বী পাল রাজবংশের রাজ্যচ্যুতির ঘটনা থেকেই বোঝায় যায় যে, সেই সময় বৌদ্ধধর্মের উপর রাজনৈতিক, দার্শনিক ও নৈতিক ভাবে পিছিয়ে পড়ছিল। কিন্তু সেই সময়ও ভারতের কয়েকটি বৌদ্ধ মঠের উত্থান বৌদ্ধধর্মের অস্তিত্ব বজায় রেখেছিল। খ্রিস্টীয় ১৩শ শতাব্দীতে মুসলমানেরা সেগুলি আক্রমণ করে। সেইটিই ছিল ভারতে বৌদ্ধধর্মের উপর শেষ আঘাত।

খ্রিস্টীয় ১৩শ শতাব্দীতে তুর্কি গোষ্ঠীপতি বখতিয়ার খিলজি অবধের সেনানায়ক নিযুক্ত হয়। ফারসি ইতিহাসবিদ মিনহাজ-ই-সিরাজ তাঁর তাবাকাত-ই-নাসিরি গ্রন্থে পরবর্তী কয়েক দশকে বখতিয়ার খিলজির লুটতরাজের বিবরণ নথিভুক্ত করেছেন। বিহার সীমান্তের দুটি গ্রাম খিলজির হাতে সমর্পিত হয়েছিল। এই গ্রামদুটি রাজনৈতিকভাবে কার্যত মালিকানাহীন অঞ্চলে পরিণত হয়। সুযোগ বুঝে খিলজি বিহারে লুটতরাজ শুরু করেন। তাঁর উর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষ তাঁকে এই কাজের জন্য স্বীকৃতি ও পুরস্কার দুইই দেন। এতে উদ্বুদ্ধ হয়ে খিলজি বিহারের একটি দূর্গ আক্রমণের সিদ্ধান্ত নেন এবং সেটি দখল করতে সক্ষমও হন। এই দূর্গ থেকে তিনি প্রচুর ধনসম্পত্তি লুট করেন। তাবাকাত-ই-নাসিরি গ্রন্থে এই লুণ্ঠনের বিবরণ পাওয়া যায়:

"মুহাম্মদ-ই-বখত-ইয়ার সাহসের সঙ্গে খিড়কি দরজা দিয়ে সেই স্থানে প্রবেশ করেন, দূর্গটি দখল করেন এবং প্রচুর সামগ্রী লুট করেন। সেই স্থানের অধিকাংশ বাসিন্দাই ছিলেন ব্রাহ্মণ এবং এই সকল ব্রাহ্মণদের সকলেরই মস্তক ছিল মুণ্ডিত। তাঁদের সকলকে হত্যা করা হয়। সেখানে প্রচুর বই ছিল। বইগুলি দেখতে পেয়ে মুসলমানেরা কয়েকজন হিন্দুকে আদেশ দেয়, তারা যেন সেই বইগুলি সম্পর্কে তাদের তথ্য দেয়। কিন্তু সকল হিন্দুকেই হত্যা করা হয়েছিল। [বইগুলির বিষয়বস্তু সম্পর্কে] অবহিত হওয়ার পর জানা যায়, সেই দূর্গ ও শহরটি ছিল একটি মহাবিদ্যালয়। হিন্দুদের ভাষায় তাঁরা সেটিকে বলতেন একটি মহাবিদ্যালয় [مدرسه] বিহার।"

উপরিউক্ত উদ্ধৃতিতে একটি বৌদ্ধ মঠ (বিহার) ও তার ভিক্ষুদের (মুণ্ডিতমস্তক ব্রাহ্মণ) উপর আক্রমণের কথা বলা হয়েছে। এই ঘটনার সঠিক তারিখটি জানা যায় না। গবেষকদের মতে, এই ঘটনাটি ঘটেছিল ১১৯৭ থেকে ১২০৬ খ্রিস্টাব্দের মধ্যবর্তী কোনও এক সময়ে। অনেক ইতিহাসবিদ মনে করেন, যে মঠটিকে দূর্গ বলে ভুল করা হয়, সেটি ছিল ওদন্তপুরা। 

তবে কয়েকজনের মতে, সেই মঠটি ছিল নালন্দা। এও মনে করা হয়, যেহেতু দুটি মহাবিহারই কয়েক মাইলের ব্যবধানে অবস্থিত ছিল, সেহেতু উভয়ের ক্ষেত্রেই একই ঘটনা ঘটেছিল। সেই যুগের অপর দুই মহাবিহার বিক্রমশিলা ও পরে জগদ্দল একই সময়ে তুর্কিদের হাতেই ধ্বংসপ্রাপ্ত হয়।

এই সময়কার ঘটনাবলির একটি গুরুত্বপূর্ণ বিবরণ হল তিব্বতি ভিক্ষু-তীর্থযাত্রী 'ধর্মস্বামীর' জীবনী। তিনি ১২৩৪ থেকে ১২৩৬ খ্রিস্টাব্দের মধ্যে ভারতে আসেন। ১২৩৫ খ্রিস্টাব্দে তিনি যখন নালন্দা দর্শন করেন, তখনও এই মহাবিহারটি চালু ছিল। তবে লুণ্ঠিত নালন্দার অবস্থা তখন ছিল শোচনীয়। তুর্কি মুসলমানেরা নালন্দার অধিকাংশ ভবনেরই ক্ষতিসাধন করেছিল এবং সেগুলি ভগ্নপ্রায় অবস্থায় পড়ে ছিল। দুটি বিহার তখনও ব্যবহারযোগ্য অবস্থায় ছিল। তিনি ধর্মস্বামী এই দুটি বিহারের নাম ‘ধনব’ ও ‘ঘুনব’ হিসেবে উল্লেখ করেন। সেখানে রাহুল শ্রীভদ্র নামে এক নবতিপর শিক্ষক ৭০ জন ছাত্রকে শিক্ষাদান করতেন। 

'ধর্মস্বামী' মনে করতেন, কুসংস্কারগত কারণে মহাবিহারটিকে সম্পূর্ণ ধ্বংস করা হয়নি। কারণ, নালন্দা চত্বরের জ্ঞাননাথ মন্দিরটি অপবিত্র করার পরেই এক মুসলমান সেনা অসুস্থ হয়ে পড়েছিল।

'ধর্মস্বামী' ছয় মাস রাহুল শ্রীভদ্রের কাছে নালন্দায় অধ্যয়ন করেন। কিন্তু তিনি নালন্দার ঐতিহাসিক গ্রন্থাগারটির কথা উল্লেখ করেননি। সম্ভবত তুর্কি আক্রমণের ফলে সেটি সম্পূর্ণ ধ্বংসপ্রাপ্ত হয়েছিল। তবে তিনি নালন্দার উপর আরেকটি আক্রমণের প্রত্যক্ষদর্শী ছিলেন। নিকটবর্তী ওদন্তপুরা (অধুনা বিহার শরিফ) তখন একটি সামরিক প্রধান কার্যালয়ে রূপান্তরিত হয়েছিল। সেখানকার সৈন্যেরা নালন্দা আক্রমণ করেন। কেবলমাত্র 'ধর্মস্বামী' ও তাঁর শিক্ষকই রয়ে যান এবং তাঁরা লুকিয়ে পড়েন। অন্য ভিক্ষুরা নালন্দা ছেড়ে পালিয়ে যান। সমসাময়িক তথ্যসূত্রের সমাপ্তি এখানেই ঘটেছে। আর পরিস্কার ভাবে বোঝা যায়ে বিদেশ থেকে ভারত লুঠ করার মানসিকতা নিয়ে আগত বর্বর এবং শিক্ষার মর্ম বুঝতে অপারগ তুর্কি মুসলমানদের হাতেই ধ্বংস হয়ে তথকালিন পৃথিবীর বৃহত্তম মহাবিদ্যালয় নালন্দা।


তথ্যঃ- বাংলা উইকিপেডিয়া

No comments:

Post a Comment

loading...
loading...