ব্লগঃ- বামেদের মুখে বিপ্লবের কথা থাকবে না এটা ভাবাই যায়ে না। তারা যা কিছু করে সবই বিপ্লবের জন্য। পক্ষান্তরে বলা যায়ে তারা যা কিছুই করে সবই বিপ্লবের নামে চাপিয়ে দেয় বা দিতে চায়ে। এমন কি ওদের কাছে সন্দেহের বশবর্তী হয়ে মানব হত্যা করাটাকেও অনেক সময়ই বিপ্লব বলে চালানো হয়ে। অনেকটা যেমন আমাদের মাও-বাদিরা করছে। এই বিপ্লবের নামে স্তালিন-মাও-চে থেকে শুরু করে এখনের কিম জং সবাই মানুষ মেরেছে। কিন্তু এদের সকলকেই ছাপিয়ে গেছেন একটি ছোট্ট এশিয় দেশের বামপন্থী ডিক্টেটর। তিনি এক অখ্যাত বাম নেতা পল পট। হ্যাঁ তিনি কখনোই স্তালিন-মাও-চে দের মত মানুষ মেরেও সুখ্যাতি পান নি। কারণ হয়েতো তিনি এসব লুকিয়ে নয়ে বুক চিতিয়ে প্রকাশ্যে করেছিলেন। ১৯৭৫ থেকে ১৯৭৯-র এই স্বল্প সময় রাজত্ব্য করেই চার ভাগের এক ভাগ জনগণকে বিপ্লবের নামে হত্যা করেছিলেন। মানুষ মারার রেকর্ডে তিনি স্তালিন-মাও-চে সকলকেই হারিয়ে দিয়েছেন।
কম্বোডিয়া ছিল ফরাসী কলোনি। ১৯৫৪ সালে স্বাধীনতা লাভের পরে সেখানে ক্ষমতায়
ছিলেন রাজা নরোদম সিহানুক। দমননীতির মাধ্যমে ক্ষমতা টিকিয়ে রাখা এবং ১৯৫৫তে
বিতর্কিত নির্বাচনের দ্বারা তিনি বিরোধী বামদের মনে এই ধারনা গেথে দিতে
সমর্থ হন যে নিয়মতান্ত্রিক পন্থায় আসলে ক্ষমতার পরিবর্তন সম্ভব নয়। তা
সত্ত্বেও দুর্বল হবার কারনে কম্বোডিয়ার সমাজবাদী দলগুলো তখন রাজতন্ত্রের
বিরুদ্ধে কোন তীব্র আন্দোলন কিংবা বিপ্লব গড়ে তুলতে পারে নি।
সে সময়টাতে আরো অনেকের মত "স্যালথ সার" নামে এক কম্বোডিয়ান যুবকও স্বপ্ন
দেখত শোষিতের মুক্তির। একটি শ্রেনীহীন সমাজের, বৈষম্যহীন রাষ্ট্রের।
ফ্রান্সে উচ্চ শিক্ষারত সময়েই তার মনে দাগ কাটে এই সমাজবাদী ধ্যান ধারনা।
১৯৫৪ সালে ফ্রান্স থেকে ফিরে স্যালোথ তখন স্বীকৃত কমিউনিস্ট পার্টি এবং
আন্ডারগ্রাউন্ড কমিউনিস্ট পার্টিদের নিয়ে কাজ করা শুরু করেন।
সরকারের দমননীতি বাড়তে বাড়তে এমন পর্যায়ে চলে যায় যে, ১৯৬২ সাল থেকে কমিউনিস্ট দলগুলো আর নিয়মতান্ত্রিক রাজনীতি করতে পারে নি। ১৯৬৩তে স্যালোথকে চলে যেতে হয় আত্মগোপনে, কারন তার উপরে নেমে এসেছে সরকারের খড়গহস্ত। ১৯৬৩তেই তিনি পার্টি সেক্রেটারী নির্বাচিত হন। সরকারের স্বৈরাচার এবং অপশাসনের ফলে দ্রুত বাড়তে থাকে খেমাররুজদের তৎপরতা। একসময় খেমাররুজরা দখল করতে শুরু করে কম্বোডিয়ার বিভিন্ন অংশ। খেমাররুজ নেতা স্যালথ সার ওরফে পল পট পরিচিত হন "ব্রাদার নাম্বার ওয়ান" নামে।
১৯৭০ সালে আমেরিকার সাহায্য নিয়ে জেনারেল লন নল উৎখাত করেন প্রিন্স সিহানুককে। যার ফলে সিহানুক এবং খেমাররুজদের মধ্য এক জাতীয় সমঝোতা তৈরী হয়। লন নলের দমননীতি এবং তৎকালীন অস্থিতিশীলতার ফলে বাড়তে থাকে খেমাররুজ গেরিলাদের তৎপরতা। শেষ পর্যন্ত ১৯৭৫ সালে খেমাররুজ গেরিলারা দখল করে নেয় নমপেন এবং কম্বোডিয়া।
১৯৭২ সালে ক্ষমতা দখলের আগেই খেমাররুসজ গেরিলারা মাজ পরিবর্তনের দিকে জোর দেয়। খেমাররুজ নিয়ন্ত্রিত এলাকাগুলোতে তারা পোশাক এবং অন্যান্য বিষয়ে নিজেদের শৃঙ্খলা প্রতিষ্ঠিত করতে সক্ষম হয়। পল পট ভূমি সংস্কার বিষয়ে মনোযোগী হন। যার ভিত্তি ছিল সম আয়তনের ভূমির মালিকানা। এসময় তারা সমস্ত প্রাইভেট যান চলাচল বন্ধ করে দেয়। ১৯৭২ এ তাদের নীতি ছিল স্বাধীন এলাকাগুলোর দিকে মানুষ কমিয়ে দেয়া। এসব নীতি দরিদ্র কৃষকের জন্য সুবিধাজনক হলেও তা শহুরে রিফিউজিদের জন্য কষ্টকর হয়ে দাড়ায়। ১৯৭৩ সালে পল পট ডিক্রি জারী করেন যাতে কৃষিভিত্তিক গ্রামগুলোতে সমিতি মালিকানা প্রতিষ্ঠিত হয় এবং ব্যক্তি মালিকানা নিষিদ্ধ হয়।
পল পট মাওবাদী নীতি গ্রহন করেন যেখানে কৃষকরাই হচ্ছে সত্যিকার মেহনতী শ্রেনী। শহর থেকে আসা মানুষগুলোর অধিকার কমে যায়, কমে যায় তাদের রেশন। মার্চের ২০, ১৯৭৬ এর নির্বাচনে এরা ভোট দিতে পারেনি, যদিও কম্বোডিয়ার সংবিধান সবার অধিকার নিশ্চিত করেছিল। খেমাররুজ নিয়ন্ত্রিত রেডিও দাবী করত তাদের কৃষিভিত্তিক সমাজের স্বপ্নপূরনের জন্য এক থেকে দুই মিলিয়ন মানুষই যথেষ্ট। বাকীদের জন্য তাদের মেসেজ ছিল, "তোমাদের রেখে কোন লাভ নেই, তোমাদের বিনাশে কোন ক্ষতি নেই।"
১৯৭৫ সালে ক্ষমতা দখলের পর থেকেই একের পর এক পরিবর্তনের দিকে জোড় দিতে থাকে পল পট। তিনি মনে করতেন অতীতের কাম্পুচিয়া সাম্রাজ্যের গৌরব ফিরিয়ে আনার জন্য দরকার সেই সময়ের মত জীবন ধারা। সব থেকে আগে তিনি কম্বোডিয়ার প্রায়ে সকল আধুনিক কল-কারখানা বন্ধ করিয়ে দেন। কৃষক ছাড়া বাকি সকল শ্রেণীর মানুষদের তাঁর প্রশাসন বুর্জোয়া শ্রেণীভুক্ত বলে ঘোষণা করে দেন। এর পর থেকেই শুরু হয় বিপ্লবের নামে গণ-নিধন। এই হত্যা কাণ্ডে আট থেকে আশি কেউই রক্ষা পায়েনি। শিক্ষক, ব্যবসায়ী, প্রশাসনের সঙ্গে যুক্ত ব্যাক্তি এমনকি কৃষকরাও রক্ষা পায়েনি। যখন তখন যে কোন মানুষকে বাম্পন্থার জন্য বিপদ জনক বলে হত্যা করা হত। ১৯৭৬ সালে ভিয়েতনাম এই কমিউনিস্ট ডিক্টেটর কে ক্ষমতা চ্যুত করার পর বিভিন্ন সরকারি নথি ঘেটে দেখা গেছে পল পটের ৪ বছরের শাসনকালে প্রায়ে ২০ লক্ষ মানুষকে হত্যা করা হয়েছিল। যদিও একেবারে ১০০% সঠিক ভাবে এই সংখ্যা বলা অসম্ভব কারণ অনেক নথিকেই তারা নষ্ট করে দিয়েছিল। তবে এই সংখ্যাটা হলেও তা ঐ দেশের মোট জনসংখ্যার প্রায়ে ৪ ভাগের ১ ভাগ।
পল পট বন্ধু রাষ্ট্র হিসেবে রাশিয়ার পরিবর্তে বেছে নেন চীনকে। ভিয়েতনাম
ছিল রাশিয়ার বলয়ভূক্ত। ১৯৭৬ সালের ডিসেম্বরে পট পট ভিয়েতনামকে শত্রু
রাষ্ট্র হিসেবে ঘোষনা করে। ভিয়েতনামের সাথে বেশ কয়েকটি সংঘর্ষের পরে
ভিয়েতনামের কাছে খেমাররুজ গেরিলারা ক্ষমতা হারায় ১৯৭৯ সালে এবং খেমাররুজ গেরিলারা এবং পল পট চলে যান আত্মগোপনে। ১৯৮৫
সালে তাদের এলাকাগুলোতে ভিয়েতনামের আক্রমন তীব্রতর হওয়ায় পল পট থাইল্যান্ডে
পালাতে বাধ্য হন। ভিয়েতনাম ১৯৮৯ সালে কম্বোডিয়া থেকে যাবার পরে নতূন
কম্বোডিয়ান সরকার খেমাররুজ গেরিলাদের সাথে শান্তি চুক্তি করতে আগ্রহী হলেও পল পট তাতে রাজী হন নি। অন্যদিকে সন্দেহ করতে থাকেন তার সবচেয়ে ঘনিষ্ঠ
বন্ধু সোন সেনকে সরকারের পক্ষে কাজ করার জন্যে। তীব্র হয়ে যায় খেমাররুজদের
অন্তর্কলহ। এরই এক পর্যায়ে সোন সেনকে মৃত্যুদন্ড কার্যকর করেন পল পট।
কিন্তু এর পরে আরেক খেমাররুজ নেতা টা মক পল পটকে গ্রেফতার করে নির্বাসন
দেন। পল পট সম্পূর্নরূপে হারান খেমাররুজদের সমর্থন। ১৯৯৮ সালে এই হাউস
এরেস্ট অবস্থাতেই তার মৃত্যু ঘটে।
কম্বোডিয়ার একটি গণ কবর থেকে পাওয়া কঙ্কাল |
খেমাররুজ কর্তৃক কম্বোডিয়ানদের এই রক্ত তাদের আদর্শের রক্ত। পল পট এবং
খেমাররুজ গেরিলারা কম্বোডিয়াতে "ইয়ার জিরো" নামে একটি নূতন আদর্শ প্রতিষ্ঠা
করতে চেয়েছিলেন, যেখানে সভ্যতা আবার নূতন করে শুরু হবে। আগের সমাজের সমস্ত
মূল্যবোধ এবং ট্রাডিশনকে ধ্বংস করে নূতন একটি সংস্কৃতি দিয়ে শুরু হবে
কম্বোডিয়া। যার ফলে তাদের মূল টার্গেট হয়ে যায় বুদ্ধিজীবী এবং শিক্ষকরা।
গ্রাম ও কৃষিভিত্তিক একটি সমাজ প্রতিষ্ঠার লক্ষে খেমাররুজ বাহিনী শহর থেকে
বহিষ্কার করে এর অধিবাসীদের, বন্ধ করে দেয় বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান। ১৯৮৮
সালে থাইল্যান্ডে পল পট তার সময়কালের হত্যাকান্ডকে ভিয়েতনামী এজেন্টদের কাজ
বলে দাবী করেন। তবে তিনি পরাজিত লন নল ও তাদের নেতাদের হত্যাকান্ডের দায়
নেন।
এত কিছুর পরেও তিনি বলেছিলেন,
"মানুষ হত্যা কিংবা জাতিকে হত্যা করার জন্যে আমি বিপ্লবে যোগ দেই নি। আমার দিকে তাকাও। আমাকে কি হিংস্র দেখায়?"
No comments:
Post a Comment