ওয়েবডেস্কঃ- নাথুরাম গডসেকে গান্ধী হত্যা(মতান্তরে বধ) করার অপরাধে গ্রেফতার
করা হয়। আদালতে ট্রাইব্যুনাল শুরু হয়, ২৭ মে ১৯৪৮ সালে এবং ১০ ফেব্রুয়ারি ১৯৪৯ সালে শেষ হয়। তাকে মৃত্যুদণ্ডে দন্ডিত করে আদালত। এই রায়কে চ্যালেঞ্জ করে পাঞ্জাব হাইকোর্টের আপিল করলেও সাজা মাফ করেনি আদালত। বিচার চলা কালিন গডসে ১৫ মিনিটের এক বক্তব্যে তিনি বিস্তৃত ভাবে জানান যে তিনি কেন গান্ধীকে হত্যা বা বধ করেছিলেন। এই বক্তব্য এমনই ছিল যে, বিচারকদের মধ্যে একজন,“জি
ডি খুসলা” পরে লিখেছিলেন,“তবে আমার কোন সন্দেহ নেই যে, সেই দিনটি
শ্রোতাদের একটি বড় অংশ গডসের আপিলের সিদ্ধান্তের কি সিদ্ধান্ত হয় সেই দিকে
তাকিয়েছিলেন , তাদের মধ্যে সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষ এটাই ভেবেছিল যে ,গডসে
“দোষী নয়” এমন একটি রায় আনা হবে।
কেন গান্ধীকে মেরে ফেললেন গডসে ?
তাঁর সেই ১৫ মিনিটের বক্তব্যটি নিচে তুলে ধরা হল যা শুনে বিচারক সমেত কোর্টে উপস্থিত থাকা প্রায়ে সকলেই মন্ত্রমুগ্ধ হয়ে গিয়েছিল।
‘একটি নিবেদিতপ্রাণ ব্রাহ্মণ পরিবারে জন্ম নেয়ায় আমি স্বাভাবিকভাবে
হিন্দু ধর্ম, হিন্দু ইতিহাস ও হিন্দু সংস্কৃতির প্রতি আকৃষ্ট হয়ে পড়ি।
হিন্দুত্বের প্রতি আমার গভীর মমত্ববোধ জেগে উঠে। বয়োবৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে
আমার মধ্যে কুসংস্কার ও ধর্মীয় গোড়ামিমুক্ত স্বাধীন চিন্তার বিকাশ ঘটে। যে
জন্য আমি অচ্ছুত প্রথা ও জন্মগত বর্ণভেদ উচ্ছেদে নিজেকে নিয়োজিত করি। আমি
খোলাখুলি জাতপাত বিরোধী আন্দোলনে যোগদান করি এবং বিশ্বাস করতে শুরু করি,
সামাজিক ও ধর্মীয় অধিকারের প্রশ্নে প্রতিটি হিন্দুর মর্যাদা সমান। শুধু
যোগ্যতার ভিত্তিতেই উচ্চ-নিচ ভেদাভেদ হতে পারে। এ ভেদাভেদ জন্মগতভাবে কোনো
বিশেষ বর্ণের বা পেশার কারণে হতে পারে না। আমি প্রকাশ্যে বর্ণবাদ বিরোধী
ভোজে অংশ নেই। এসব ভোজে হাজার হাজার হিন্দু ব্রাহ্মণ, ক্ষত্রিয়, কায়স্থ,
বৈষ্য, চামার ও বাঙ্গি যোগ দেয়। আমরা বর্ণভেদ প্রথা ভেঙ্গে দেই এবং একে
অপরের সঙ্গে খাবার খাই।
‘আমি প্রাচীন ও আধুনিক ভারতের ইতিহাস পাঠ করেছি। ইংল্যান্ড, আমেরিকা
ও রাশিয়ার মতো কয়েকটি প্রভাবশালী দেশ সম্পর্কেও পড়াশোনা করেছি। তাছাড়া,
দাদাভাই নওরোজি, স্বামী বিবেকানন্দ, গোখলে ও তিলকরত্নের লেখা বই-পুস্তক ও
বক্তৃতাও প্রচুর পাঠ করেছি। শুধু তাই নয়, আমি সমাজতন্ত্র ও মার্কসবাদের মূল
বিষয়বস্তুও পাঠ করেছি। তবে আমি বিশেষভাবে পাঠ করেছি বীর সাভারকার ও
গান্ধীজীর লেখা বই-পুস্তক ও তাদের বক্তৃতা। আমি বিশ্বাস করি, বিগত ত্রিশ
বছর যাবৎ এ দু’ব্যক্তির চিন্তা ও কার্যকলাপ ভারতীয়দের যতদূর প্রভাবিত করেছে
অন্য কোনো ব্যক্তির চিন্তা ও আদর্শ ততটুকু প্রভাব বিস্তারে সক্ষম হয়নি।
এসব পড়াশোনা ও চিন্তা-ভাবনা থেকে আমি ভাবতে শুরু করি, একজন দেশপ্রেমিক ও
বিশ্ব নাগরিক হিসাবে হিন্দুরাজ ও হিন্দুত্ব প্রতিষ্ঠা করাই আমার প্রথম কাজ।
৩০ কোটি হিন্দুর ন্যায়সঙ্গত স্বার্থরক্ষা এবং তাদের স্বাধীনতা নিশ্চিত হলে
স্বয়ংক্রিয়ভাবে মানবজাতির এক-পঞ্চমাংশের স্বাধীনতা ও কল্যাণ প্রতিষ্ঠিত
হবে। এ বিশ্বাস আমাকে হিন্দু সনাতনী আদর্শ ও কর্মসূচির প্রতি আত্মনিয়োগে
অনুপ্রাণিত করে। আমি আরো বিশ্বাস করতে শুরু করি, হিন্দু সনাতনী আদর্শই কেবল আমার মাতৃভূমি হিন্দুস্তানের জাতীয় স্বাধীনতা অর্জন ও সংরক্ষণ করতে পারে।
১৯২০ সালে লোকমান্য তিলকের মৃত্যুর পর থেকে প্রথমবার কংগ্রেসে
গান্ধীজীর প্রভাব বৃদ্ধি পায় এবং পরে কংগ্রেসে তার প্রভাব নিরংকুশ হয়ে
দাঁড়ায়। জনগণকে সচেতন করে তোলার জন্য গান্ধী যে ভূমিকা পালন করেছেন, তা ছিল
তাদের কাছে অতীব গুরুত্বপূর্ণ। গান্ধীর অহিংস ও সত্যাগ্রহ শেস্নাগানের ফলে
জনগণের মধ্যে তার প্রভাব আরো বৃদ্ধি পায়। কোনো সচেতন ও শিক্ষিত লোক এ
শেস্নাগানের বিরোধিতা করেনি। এসব শেস্নাগানে কোনো নতুনত্ব ছিল না। যে কোনো
গণআন্দোলনেই এসব শেস্নাগান দেয়া হয়। তবে কখনো কখনো দেশ আমাদেরকে অহিংসার পথ
অগ্রাহ্য করতে এবং শক্তি প্রয়োগে বাধ্য করে। আমি কখনো এ কথা চিন্তা করিনি
যে, আগ্রাসনের বিরুদ্ধে সশস্ত্র প্রতিরোধ অন্যায়। আমি আগ্রাসী শত্রুকে
শক্তি প্রয়োগে পরাভূত করা এবং প্রতিরোধ করা আমার ধর্মীয় ও নৈতিক কর্তব্য
বলে মনে করেছি। রামায়ণের বর্ণনা অনুযায়ী রাম সীতাকে উদ্ধারে রাজা
রাবনের সঙ্গে লড়াই করেছিলেন। মহাভারতের বর্ণনানুযায়ী কৃষ্ণ কংসের পাপাচারের
অবসান ঘটাতে তাকে হত্যা করেছিলেন এবং অর্জুনকে তার আত্মীয় ও
বন্ধুবান্ধবদের সঙ্গে লড়াই করে তাদেরকে হত্যা করতে হয়েছে। শুধু তাই নয়,
তাকে পরম পূজিত ভীমের সঙ্গেও লড়াই করতে হয়েছে। কারণ ভীম ছিলেন আগ্রাসীদের
পক্ষে। আমার দৃঢ় বিশ্বাস, রাম, কৃষ্ণ ও অর্জনকে সহিংসতার অবতার হিসাবে
অভিযুক্ত করে মহাত্মা গান্ধী মানুষের স্বাভাবিক আচরণের প্রতি চরম অজ্ঞতা
প্রদর্শন করেছেন।
‘নিকট অতীতে ছত্রপতি শিবাজিই প্রথম মুসলিম আগ্রাসনের বিরুদ্ধে
বীরোচিত প্রতিরোধ গড়ে তোলেন এবং ভারতে মুসলিম উৎপীড়নের মূলোৎপাটন করেন।
আগ্রাসী আফজাল খানকে হত্যা করা ছিল শিবাজির জন্য অবশ্য কর্তব্য। নয়তো তিনি
নিজেই নিহত হতেন। শিবাজি, রানা প্রতাপ ও গুরু গোবিন্দের মতো
ঐতিহাসিক বীর যোদ্ধাদের বিপথগামী দেশপ্রেমিক হিসাবে নিন্দা করে গান্ধীজী
নিজের আত্মম্ভরিতা প্রকাশ করেছেন। গান্ধীজী অহিংস ও সত্যাগ্রহ নীতির নামে
দেশে অবর্ণনীয় দুর্দশা ডেকে এনেছেন। পক্ষান্তরে, রানা প্রতাপ,
শিবাজি ও গুরুগোবিন্দ তাদের জাতিকে যে মুক্তি এনে দিয়েছিলেন সেজন্য তারা
জাতির হূদয়ে চিরজাগরুক হয়ে থাকবেন।
‘গান্ধীজী বিগত ৩২ বছর ধরে যে বাগাড়ম্বর করেছেন সেটা তার
মুসলিমপন্থি আমরণ অনশনে পূর্ণতা লাভ করে। গান্ধীর এ অনশন আমাকে এ সিদ্ধান্ত
নিতে বাধ্য করে যে, দ্রুত তার অস্তিত্ব নাশ করতে হবে। তিনি
দক্ষিণ আফ্রিকায় ভারতীয়দের অধিকার ও কল্যাণে যথেষ্ট অবদান রেখেছেন। কিন্তু
ভারতে প্রত্যাবর্তন করার পর তার মধ্যে রাজানুগত্যের একটি মনোভাব জন্ম নেয়।
তিনি এমন এক পরিস্থিতিতে কাজ করতে থাকেন যেখানে তার কাজকর্মের ভালোমন্দের
বিচার করতেন শুধু তিনি নিজে। দেশ যদি তার নেতৃত্ব চেয়ে থাকে তাহলে দেশকে
তার অভ্রান্ততাও গ্রহণ করতে হবে। আর যদি তা না হয়ে থাকে তাহলে তাকে কংগ্রেস
থেকে দূরে সরে যেতে হবে এবং নিজের পথে চলতে হবে। এ অবস্থায় কোনো মাঝামাঝি
পথ নেই। হয়তো কংগ্রেসকে তার পাগলামি, খামখেয়ালি ও পুরনো ধ্যানধারণা গ্রহণ
করতে হবে নয়তো কংগ্রেসকে গান্ধীকে বাদ দিয়ে চলতে হবে। অসহযোগ আন্দোলন হচ্ছে
গান্ধীর মস্তিষ্কপ্রসূত চিন্তা। এ আন্দোলনের কৌশল কারো জানা ছিল না। কখন
আন্দোলন শুরু করতে হবে এবং এ আন্দোলনে বিরতি দিতে হবে সবই ছিল গান্ধীর একক
সিদ্ধান্ত। এ আন্দোলন ব্যর্থ কিংবা সফল হোক, রাজনৈতিক পরিস্থিতি যাই দাঁড়াক
তাতে গান্ধীর কিছুই আসতো যেতো না। তার ইচ্ছাই ছিল চূড়ান্ত। ‘একজন
সত্যাগ্রহী কখনো ব্যর্থ হতে পারে না’ এটাই ছিল তার মূলমন্ত্র। কিন্তু
সত্যাগ্রহ বলতে কি বুঝায় তিনি ছাড়া তা আর কারো জানা ছিল না। এভাবে গান্ধী
নিজেই নিজের কাজকর্মের বিচারক ও জুরি দু’টিই হয়ে দাঁড়ান। কঠোর কৃচ্ছ্রতা,
নিরবচ্ছিন্ন কাজ ও বৈশিষ্ট্যপূর্ণ চরিত্রের সঙ্গে উন্মত্ততা ও ছেলেমানুষীর
সংমিশ্রণে গান্ধী এক অপ্রতিরোধ্য ও অপরিবর্তনযোগ্য নেতায় পরিণত হন। অনেকেই
মনে করতেন, তার রাজনীতি ভুল। কিন্তু এদেরকে হয়তো কংগ্রেস ছাড়তে হয়েছে নয়তো
তার খামখেয়ালির কাছে নিজেদের বিবেক বুদ্ধিকে জলাঞ্জলি দিতে হয়েছে। চরম
দায়িত্বহীনতার একটি পর্যায়ে গান্ধী একটির পর একটি ভুল করে গেছেন। একটির পর
একটি ব্যর্থতা তাকে গ্রাস করছিল। তার নেতৃত্বে উপর্যুপরি দুর্যোগ আসছিল।
‘গান্ধীর মুসলিমপ্রীতির পরিচয় ফুটে উঠে ভারতের জাতীয় ভাষার প্রশ্নে
তার বিকৃত দৃষ্টিভঙ্গিতে। এটা সর্বজনবিদিত যে, জাতীয় ভাষা হিসাবে হিন্দির
দাবি ছিল সর্বাগ্রে। ভারতে তার ক্যারিয়ারের শুরুতে গান্ধী হিন্দির প্রতি
অতীব গুরুত্ব দিয়েছিলেন। কিন্তু যখন তিনি দেখতে পেলেন, মুসলমানরা হিন্দি
পছন্দ করে না তখন তিনি হিন্দুস্তানী ভাষা হিসাবে আখ্যায়িত অন্য একটি ভাষার
প্রবক্তা সাজেন। ভারতের প্রত্যেকেই এ কথা জানে, হিন্দুস্তানী নামে কোনো
ভাষা নেই। এ ভাষার কোনো ব্যাকরণ অথবা কোনো শব্দ ভাণ্ডারও নেই। হিন্দুস্তানী
ভাষা হচ্ছে একটি কথ্য ভাষা। তবে লিখিত ভাষা নয়। এটা হচ্ছে হিন্দি ও উর্দুর
সংমিশ্রণে একটি জারজ ভাষা। গান্ধীর প্রচারণা সত্ত্বেও এটি জনপ্রিয় হতে
পারেনি। তিনি মুসলমানদের তুষ্ট করার জন্য বলেছিলেন, হিন্দুস্তানী হবে
ভারতের জাতীয় ভাষা। তার অন্ধ অনুসারীরা তাকে অনুসরণ করে এবং তথাকথিত এ ভাষা
ব্যবহার করতে শুরু করে। মুসলমানদের সন্তুষ্ট করার জন্য হিন্দি ভাষার
সৌকর্য ও মাধুর্য বিসর্জন দেয়া হয়। গান্ধী এসব পরীক্ষা-নিরীক্ষা করছিলেন হিন্দু স্বার্থকে বলি দিয়ে।
‘১৯৪৬ সালের আগস্ট থেকে মুসলিম ভাড়াটিয়া বাহিনী হিন্দু নিধনে মেতে
উঠে। তদানীন্তন লর্ড ওয়াভেল এসব ঘটনায় মর্মাহত হলেও তিনি ১৯৩৫ সালের ভারত
শাসন আইন অনুযায়ী ধর্ষণ, হত্যা ও অগ্নিকান্ড বন্ধে তার কতৃত্ব প্রয়োগ
করেননি। বাংলা থেকে করাচি পর্যন্ত হিন্দুর রক্তে রঞ্জিত হয়। কোথাও কোথাও
হিন্দুরা প্রতিশোধ গ্রহণে হামলা চালায়। (প্রকৃতপক্ষে ১৯৪৬ সালের
হিন্দু-মুসলিম দাঙ্গার জন্য দু’নো পক্ষই দোষী কিন্তু খেয়াল করুন উগ্রবাদী
মানসিকতার জন্য একটি নিদিষ্ট পক্ষের দোষ তার চোখেই পরলো না)
১৯৪৬ সালের সেপ্টেম্বরে অস্থায়ী সরকার গঠিত হয়। কিন্তু শুরু থেকে এ
সরকারের মুসলিম সদস্যরা সরকারের বিরুদ্ধে অন্তর্ঘাতে লিপ্ত হয়। মুসলমানরা
যে সরকারের অংশ ছিল সে সরকারের বিরুদ্ধে তারা যত বেশি আনুগত্যহীন ও উদ্ধত
হয়ে উঠছিল, গান্ধী তত বেশি তাদের প্রতি মোহাবিষ্ট হচ্ছিলেন। সংকট
নিষ্পত্তিতে ব্যর্থ হয়ে লর্ড ওয়াভেল পদত্যাগ করেন এবং লর্ড মাউন্টব্যাটেন
তার স্থলাভিষিক্ত হন।
‘কংগ্রেস জাতীয়তা ও সমাজতন্ত্রে বিশ্বাস করতো। কিন্তু তারা বেয়নেটের
মুখে গোপনে পাকিস্তান দাবি মেনে নেয় এবং জিন্নাহর কাছে নির্লজ্জভাবে
আত্মসর্মপণ করে। ভারত বিভক্ত হয় এবং ১৯৪৭ সালের ১৫ আগস্ট থেকে ভারতের
ভূখণ্ড আমাদের কাছে বিদেশী ভূখণ্ড হিসাবে পরিগণিত হয়। লর্ড মাউন্টব্যাটেন
কংগ্রেস সার্কেলে ভারতের শ্রেষ্ঠতম ভাইসরয় ও গভর্নর জেনারেল হিসাবে বিবেচিত
হচ্ছিলেন। ১৯৪৮ সালের ৩০ জুন আনুষ্ঠানিকভাবে ক্ষমতা হস্তান্তরের ঘোষণা
দেয়া হয়েছিল। কিন্তু ঘোষিত সময়ের ১০ মাস আগে মাউন্টব্যাটেন আমাদেরকে একটি
খণ্ডিত ভারত উপহার দেন। এটা ছিল গান্ধীর ৩০ বছরের একনায়কতান্ত্রিক
নেতৃত্বের ফসল এবং কংগ্রেস এটাকে বলছে স্বাধীনতা ও ক্ষমতা হস্তান্তর।
অবশেষে হিন্দু-মুসলিম ঐক্যের ফানুস এক সময় ফেটে যায় এবং নেহরু ও তার
সাঙ্গ-পাঙ্গদের সম্মতিতে ধর্মভিত্তিক একটি রাষ্ট্র কায়েম হয়। নেহরু ও তার
দোসররা তাদের ত্যাগের এই ফসলকে স্বাধীনতা হিসাবে আখ্যায়িত করেন। কার ত্যাগ?
গান্ধীর সম্মতিতে যখন কংগ্রেসের শীর্ষ নেতৃবৃন্দ দেশকে বিভক্ত করে ফেলে
তখন আমার মন ভয়ানক ক্রোধে ফেটে পড়তে থাকে।
‘দিলিস্নর কয়েকটি মসজিদ হিন্দুরা দখল করে নিলে গান্ধী আমরণ অনশন
শুরু করেন। তিনি শর্ত দেন, এসব মসজিদ খালি করে দেয়া না হলে তিনি অনশন ভঙ্গ
করবেন না। কিন্তু যখন পাকিস্তানে হিন্দুদের উপর ভয়াবহ হামলা চালানো হয় সে
সময় গান্ধী টু শব্দটি পর্যন্ত উচ্চারণ করেননি এবং তিনি নিন্দাও করেননি।
গান্ধী খুব ধূর্ত। তিনি পাকিস্তানি মুসলমানদের উপর কোনো শর্ত আরোপ করেননি।
তিনি জানতেন, অনশন করে মরে গেলেও কোনো পাকিস্তানি মুসলমান তার জন্য দুঃখ
পাবে না। এ কারণে তিনি পাকিস্তানি মুসলমানদের উপর কোনো শর্ত আরোপ করেননি।
অভিজ্ঞতা থেকে তিনি জানতেন, জিন্নাহ তার অনশনে বিচলিত হবেন না এবং মুসলিম
লিগ তার অন্তরাত্মার প্রতি খুব কমই গুরুত্ব আরোপ করে।
‘গান্ধীকে জাতির পিতা হিসাবে আখ্যায়িত করা হয়। যদি তাই হয় তাহলে
বিশ্বাসঘাতকতা করে দেশকে ভাঙ্গার সম্মতি দিয়ে তিনি তার পিতৃসুলভ দায়িত্ব
পালনে ব্যর্থ হয়েছেন। আমি দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করি, গান্ধী তার কর্তব্য পালনে
ব্যর্থ হয়েছেন। তিনি নিজেকে পাকিস্তানের জাতির পিতা হিসাবে প্রমাণ করেছেন।
জিন্নাহর বজ কঠিন ইচ্ছাশক্তির কাছে তার অন্তরাত্মা, আধ্যাত্মিক শক্তি ও
অহিংস মতবাদ সবই পরাজিত এবং ক্ষমতাহীন বলে প্রমাণিত হয়েছে।
‘সংক্ষেপে বলতে গেলে আমি আপন মনে ভেবেছি এবং দেখতে পেয়েছি, আমি
পুরোপুরি নিঃশেষ হয়ে গেছি। গান্ধীকে হত্যা করলে আমি জনগণের কাছ থেকে ঘৃণা
ছাড়া আর কিছুই আশা করতে পারি না এবং আমাকে আমার সকল সম্মান হারাতে হবে। তবে
আমি একই সঙ্গে এ কথাও ভেবেছি, গান্ধীর অবর্তমানে ভারতের রাজনীতি
নিঃসন্দেহে বাস্তবভিত্তিক বলে প্রমাণিত হবে, প্রতিশোধ গ্রহণের যোগ্য হবে
এবং সশস্ত্র বাহিনীর মাধ্যমে শক্তিশালী হবে। কোনো সন্দেহ নেই, আমার ভবিষ্যৎ
হবে পুরোপুরি ধ্বংস। তবে জাতি পাকিস্তানি আগ্রাসন থেকে নিরাপদ হবে। মানুষ
আমাকে বোকা কিংবা মাথামোটা বলে উপহাস করতে পারে। তবে জাতি যুক্তির পথ খুঁজে
পাবে যা একটি স্বাধীন ও বলিষ্ঠ জাতি গঠনের জন্য অপরিহার্য বলে মনে করি।
এসব বিষয় চিন্তা করে গান্ধীকে হত্যার জন্য চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত গ্রহণ করি।
কিন্তু এ কথা আমি কারো কাছে প্রকাশ করিনি। আমি আমার দু’হাতে শক্তি সঞ্চয়
করি এবং ১৯৪৮ সালের ৩০ জানুয়ারি বিড়লা হাউসে প্রার্থনা সভায় গান্ধীকে গুলি
করি।
‘আমি বলতে চাই যে, আমি এমন এক ব্যক্তির প্রতি গুলিবর্ষণ করেছি যার
নীতি ও কার্যকলাপ কোটি কোটি হিন্দুর দুঃখ, দুর্দশা ও ধ্বংস ডেকে এনেছে।
দেশে এমন কোনো আইন নেই যার আওতায় এমন এক অপরাধীর বিচার হতে পারে। তাই আমি
তার প্রতি মৃতু্যবাণ নিক্ষেপ করেছি।
‘ব্যক্তিগতভাবে কারো প্রতি আমার কোনো বিদ্বেষ নেই। তবে আমি বলতে
চাই, এ সরকারের নীতির কারণে তাদের প্রতি আমার কোনো শ্রদ্ধা নেই। এ সরকারের
নীতি হচ্ছে দৃষ্টিকটুভাবে মুসলিম ঘেঁষা। একই সঙ্গে আমি বিশ্বাস করি,
সরকারের এ মুসলিম ঘেঁষা নীতির মূলে রয়েছে গান্ধীর উপস্থিতি। আমাকে দুঃখের
সঙ্গে বলতে হচ্ছে, প্রধানমন্ত্রী নেহরু পুরোপুরি অনবহিত যে, তিনি প্রায়ই
যখন ভারতকে একটি ধর্মনিরপেক্ষ রাষ্ট্র হিসাবে উলেস্নখ করেন তখন তার কথা ও
কাজের গরমিল স্পষ্ট ধরা পড়ে। এটা উলেস্নখ করা খুবই গুরুত্বপূর্ণ,
ধর্মভিত্তিক পাকিস্তান রাষ্ট্র কায়েমে নেহরু নেতৃস্থানীয় ভূমিকা পালন
করেছিলেন এবং গান্ধীর মুসলিম তোষণ নীতির কারণে তার কাজ সহজতর হয়ে গিয়েছিল।
‘আমি যা করেছি তার দায়-দায়িত্ব আমার। তাই আমি আমার দায়ের পরিণতি
গ্রহণ করার জন্য আদালতে দাঁড়িয়েছি এবং বিচারক আমার প্রাপ্য শাস্তি আমাকে
দেবেন। আমি আরো বলতে চাই, করুণার জন্য আমি প্রার্থনা করছি না। আমি এটাও চাই
না কেউ আমার পক্ষ থেকে করুণা ভিক্ষা করুক। আমি যা করেছি সে জন্য সকল মহল
থেকে আমাকে ভর্ৎসনা করা হচ্ছে। এতে আমার আস্থায় বিন্দুমাত্র ফাটল ধরেনি।
আমার এ বিষয়ে কোনো সন্দেহ নেই, সৎ ইতিহাসবিদগণ আমার কাজের যথাযথ মূল্যায়ন
করবেন এবং ভবিষ্যতে একদিন প্রকৃত সত্যের মূল্য দেবেন।’
No comments:
Post a Comment