Saturday 14 October 2017

যে ভাবে রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষে স্বাধীন হল গোয়া,দামান,দিউ



ওয়েবডেস্কঃ- ১৯৪৭ সালে ভারত উপমহাদেশ বিভক্ত হয়ে জন্ম হয় ভারত ও পাকিস্তান। আগস্টের পূর্বে বৃটিশ ভারতে ৫৬৫ দেশীয় রাজ্য ছিল। কাশ্মীর, হায়দ্রাবাদ (অন্ধ্রপ্রদেশ) ও গোয়া প্রদেশ ভারত-পাকিস্তান কোন দেশে যোগ দেয়নি। গোয়াকে কেন্দ্র করে শুরু হয় ভারত পর্তুগালের যুদ্ধ।

  ১৫৩০ সাল থেকে পর্তুগীজ ভারতের রাজধানী গোয়া। ১৬৬১ সালে পর্তুগীজ রাজকুমারী ক্যাথরিনের সাথে বৃটিশ রাজকুমার ২য় চার্লসের বিয়ে হয়। বিয়েতে চার্লসকে যৌতুক দেয়া হয় বোম্বাই (বর্তমান মুম্বাই)। ফলে ভারতের পশ্চিম উপকূলের বিশেষত মহারাষ্ট্র থেকে দক্ষিণ পশ্চিম গুজরাটের একটা অংশ চলে আসে ব্রিটিশদের দখলে। এবং এর পর থেকে ভারতে সাম্রাজ্য বিস্তার বন্ধই করে দেয় লিসবন। সেই থেকেই বৃটিশ পর্তুগীজ সুসম্পর্ক বিদ্যমান। ছিটমহল দামান, দিউ, দাদরা, নগর হাভেলি সহ গোয়ার মোট আয়তন ৪০০০ বর্গ কিমি। ১৯৪৭ সালে গোয়ার জনসংখ্যা ৬৩৭৫৯১ জন। অনুপাত হিন্দু ৬১%, খৃস্টান ৩৬.৭%, মুসলিম ২.২%।


  ২৭ ফেব্রুয়ারী ১৯৫০। ভারত পর্তুগীজ সরকারকে পর্তুগীজ কলোনির ভবিষ্যত সম্পর্কে জানতে চেয়ে আলোচনার প্রস্তাব দেয়। পর্তুগীজ জানায় যে গোয়া ভারত উপমহাদেশের কলোনি নয় কিন্তু আধুনিক পতুর্গালের অংশ। তাই এর হস্তান্তর অসম্ভব। ভারতের গোয়ার উপর কোন অধিকার নেই। গোয়া যখন পর্তুগীজ শাসনে আসে তখন গণপ্রজাতন্ত্রী ভারতের কোন অস্তিত্ব ছিল না।

   দাদরা ও নগর হাভেলির অন্তর্ভুক্তিঃ ভারতের আলোচনা প্রস্তাব ব্যর্থ হয়। তারপর ১৯৫২ থেকে গোয়া আক্রমণের পরিকল্পনা শুরু করে ভারত। দাদরা, নগর হাভেলি ও দামান ছিটমহল ভারতের অভ্যন্তরে অবস্থিত। এই তিনটি ছিটমহলের যোগাযোগ ব্যবস্থায় প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করে ভারত।


  ভারত সমর্থিত কিছু সংগঠন (UFG, NMLO, AZD, RSS) সশস্ত্র বিদ্রোহ/বিপ্লবের পরিকল্পনা গ্রহণ করে। এদের মধ্যে অগ্রণী ভুমিকা পালন করেছিল AZD(আজাদ গোমন্তক দল) এবং  RSS(রাষ্ট্রীয় সয়ং সেবক সংঘ)।

  উল্লেখ্য ২২ জুলাই ১৯৫৪-র রাতে দাদরা পুলিশ স্টেশনে হামলা চালায় ইউ এফ জি। পরদিন সকালে ভারতীয় পতাকা উত্তোলন করে দাদরাকে স্বাধীন ঘোষণা করা হয়। ২৮ জুলাই আর এস এস ও এজিডি নারোলি পুলিশ স্টেশন ঘেরাও করে। পর্তুগীজ পুলিশ আত্নসমর্পণ করলে স্বাধীন হয় নারোলি।

  ২ আগস্ট আর এস এস ও এজিডি সিলভাসা প্রবেশ করে। ১৫০ পর্তুগীজ পুলিশ খানভেল পালিয়ে যায়। দাদরা ও নগর হাভেলি বিনা বাধায় স্বাধীনতা লাভ করে।

  পর্তুগীজ সেনা দাদরা প্রবেশ করতে চাইলেও বাধা দেয় ভারত। ১২ এপ্রিল ১৯৬০ আন্তর্জাতিক আদালত রায় দেয় যে, পর্তুগালের নিজ ভূখন্ডে প্রবেশের অধিকার আছে একইভাবে সশস্ত্র সেনা অনুপ্রবেশে বাধা দেবার অধিকারও আছে ভারতের।

   ১৫ আগস্ট ১৯৫৫ তে পুরুষ মহিলা সমেত প্রায়ে ৩০০০-৫০০০ ভারতীয়দের নিয়ে গোয়া প্রবেশের চেষ্টা করে সত্যাগ্রহ করা শুরু করেছিলেন জনসঙ্ঘ নেতা জগন্নাথ রাও জোশি। এই আন্দোলনকে অত্যন্ত ক্রুরতার সঙ্গে দমন করে গোয়া প্রশাসন। প্রায়ে ৩০ জন সত্যাগ্রহী বিরগতি লাভ করেন। আহতের সংখ্যাও ছিল প্রচুর। এই আন্দোলনের ঠিক এক বছর আগে AZD(আজাদ গোমন্তক দল) এবং  RSS(রাষ্ট্রীয় সয়ং সেবক সংঘ)-র নেতৃত্বে একই রকম সত্যাগ্রহ হয়েছিল যাকে পর্তুগীজ পুলিশ কঠোর হাতে দমন করে। কিন্তু এই আন্দোলন দেখে এক রকম ভয়ভীত হয়ে ওঠে পর্তুগীজ প্রশাসন। সেনার সংখ্যা বাড়াতে শুরু করে দেয় তারা। এই গণহত্যার কারণে গোয়াতে পতুর্গীজ অবস্থানের বিরুদ্ধে ভারতে তীব্র জনমত সৃষ্টি হয়। ১সেপ্টেম্বর ১৯৫৫ গোয়ার কনস্যুল অফিস বন্ধ করে দেয় ভারত।

   পর্তুগীজ প্রধানমন্ত্রী সালাজার ভারতীয় আগ্রাসন সম্পর্ক অবগত হয়ে ইংল্যান্ড ও রাষ্ট্রসংঘ নিরাপত্তা কাউন্সিল মধ্যস্থতার আহ্বান জানায়। রাষ্ট্রসংঘে এটাই প্রথম এমন কেস ছিল যখন একটি ইউরোপিয়ান দেশ, একটি নন-ইউরোপিয়ান দেশের ভয়ে রাষ্ট্রসংঘের কড়া নেরেছিল।

  ১৯৬০-র মার্চে পর্তুগালের প্রতিরক্ষামন্ত্রী মনিজ সালাজারকে বলেন, ভারতের বিরুদ্ধে অভিযান আত্নহত্যার সমান। মনিজের পরামর্শ অনেক সেনা কর্মকর্তা সমর্থন করলেও অগ্রাহ্য করেন সালাজার। ১৪ ডিসেম্বর গোয়ার গভর্ণর সিলভাকে সংবাদ প্রেরণ করেন সালাজার। তিনি পর্তুগীজ সেনাদের শেষ রক্তবিন্দু দিয়ে লড়াই করার আদেশ দেন। এছাড়াও কমপক্ষে ৮ দিন গোয়ার দখল ধরে রাখতে পারলে সালাজার ভারতীয় আগ্রাসনের বিরুদ্ধে আর্ন্তজাতিক সমর্থন সংগ্রহ করবেন।

   যুদ্ধ শুরুর পূর্বেই আতঙ্কিত পর্তুগীজ জনগণ গোয়া ত্যাগের প্রস্তুতি গ্রহণ করে। ৯ ডিসেম্বর লিসবন গামী জাহাজে ৭০০ পর্তুগীজ গোয়া ত্যাগ করেন। কিন্তু জাহাজের ধারণ ক্ষমতা ছিল ৩৮০ জন। জাহাজের টয়লেটেও যাত্রী ধারণ করা হয়।

  পর্তুগীজের ছিল ৪০০০ স্থল সেনা ২০০ নৌসেনা, ১টি ফ্রিগেট ও ৩টি পেট্রোল বোট। ভারতের ছিল ৪,৫০,০০০ পদাতিক, ১টি ছোট বিমান বাহী রণতরী, ২টি ক্রুসার, ১টি ডেস্ট্রয়ার, ৮টি ফ্রিগেট, ৪টি মাইন সুইপার, ২০টি ক্যানবেরা ও ৬টি হান্টার মাল্টি রোল বিমান, ৬টি ভ্যাম্পায়ার ফাইটার, ৬টি তুফানি ফাইটার ও ৪ মিস্ট্রি ফাইটার বম্বার।

গোয়া আক্রমণঃ-

এই সামরিক অভিযানের সাংকেতিক নাম অপারেশন বিজয়।

 ১লা ডিসেম্বর থেকে নজরদারি শুরু করে ভারত। INS BETWA ও INS BEAS নামে দুটি ফ্রিগেট গোয়া উপকূল থেকে ১৩ কিমি দূর থেকে প্রহরা দিচ্ছিল। বিমানবাহী রণতরী ভিক্রান্ত গোয়া উপকূল থেকে ১২১ কিমি দূরে অবস্থান নেয়। যার উদ্দেশ্য গোয়ায় অপারেশন চালানো ও বিদেশী আক্রমণ প্রতিহত করা।

    ১৭ ডিসেম্বর ১৯৬১, ৯:৪৫ মিনিটে গোয়ার উত্তর-পূর্বে মলিঙ্গম শহর দখল নেয় ভারতীয় সেনা। বিকালে পর্তুগীজ হাইকমান্ড সকল সেনাকে হেডকোয়ার্টারে ফেরত যেতে নির্দেশ দেয়। যাওয়ার পথে তারা বিচোলিম, চাপোরা ও আসোনোরা সেতু ধ্বংস করে দেয়। পরদিন ভোরে মারাঠা, পাঞ্জাব ও শিখ ব্রিগেড তিন ভাগে বিভক্ত হয়ে গোয়া প্রবেশ করে। পর্তুগীজ সেনা পানাজি পালাবার পথে বেনেস্টারিম সেতু ধ্বংস করে দেয়। বিকাল ৫:৪৫ মিনিটে তারা মান্ডোবি নদী অতিক্রম করে। কিছুক্ষণ পর নদী তীরে পৌঁছে যায় ভারতীয় ট্যাংক বাহিনী।

  রাত ৮টায় গ্রেগরিও ম্যাগনো নামে এক গোয়াবাসী নদী পার হয় এবং পর্তুগীজ সেনাবাহিনীর আত্নসমর্পণ প্রস্তাব পত্র ভারতীয় মেজর শিবদেব সিং সিধুকে প্রদান করে। সেই রাতে সংবাদ আসে যে কিছু ভারতীয় সমর্থক আগুডা দূর্গে বন্দি। মেজর সিধু বন্দীদের মুক্ত করতে সসৈন্যে দূর্গে পৌঁছান। আত্নসমর্পণের কোন নির্দেশনা না থাকায় দূর্গের পর্তুগীজ সেনারা গুলি চালায়। মেজর সিধু ও ক্যাপ্টেন বিনোদ সেহগাল নিহত হন।

   ১৯ ডিসেম্বর সকাল ৭:৩০ মিনিট, নদী পার হয়ে বিনা বাধায় পানাজী দখল নেয় ভারতীয় সেনা। সেই সাথে ট্যাংক বহরের সহায়তায় আগুডা দূর্গ দখল নেয়া হয়। ডাবলিম বিমান বন্দর যাওয়ার পথে বর্ণা গ্রাম। এখানে ৫০০ পর্তূগীজ সৈন্য তীব্র প্রতিরোধ গড়ে তোলে। প্রচন্ড যুদ্ধের পর বিকাল ৩:৩০ মিনিটে পর্তুগীজ সেনা আত্নসমর্পণ করে। এছাড়াও ১৮ ডিসেম্বর ডাবলিম বিমান বন্দরে মাত্র কয়েক মিনিটে ৬৩,০০০ পাউন্ডের বোমা বর্ষণ করে ভারতীয় বিমান বাহিনী। কয়েক বার হামলা চালিয়ে ভবন অক্ষত রেখে রানওয়ে ধ্বংস করা হয়। রাতেই দুটি পর্তুগীজ বিমান আকাশ প্রহরা এড়িয়ে পাকিস্তানের করাচি পালিয়ে যায়।

  ১.৫ বর্গ কিমির আনজিদিব দ্বীপে আক্রমণ করে ক্রুসার মহীশূর ও ত্রিশুল। ভারতীয় নৌসেনাকে প্রতিহত করে পর্তুগীজ। ৭ ভারতীয় নিহত ও ১৯ জন আহত হয়। পরদিন ১৯ ডিসেম্বর ২টায় দ্বীপের দখল নেয় ভারত। একই দিনের দুপুর ১২টায় পর্তুগীজ ফ্রিগেট আফোনসোকে গোলা ছুঁড়ে মোর্স কোডের মাধ্যমে আত্নসমর্পণের আহবান জানায় বেটোয়া ও ব্যাস নামে দুই ফ্রিগেট। জবাবে পাল্টা গোলা ছুঁড়ে আফোনসো। আফোনসোর গোলা ছোঁড়ার হার মিনিটে ২ রাউন্ড ও ভারতীয় জাহাজের মিনিটে ৬০ রাউন্ড। ১:১০ মিনিটে পর্তুগীজ নৌসেনা বিধ্বস্ত জাহাজ ত্যাগ করে সৈকতে নেমে যায়। ৫ পর্তুগীজ নিহত ও ১৩ আহত হয়। অবশ্য পরদিন আত্নসমর্পণ করে পর্তুগীজ সেনা।


  দামান আক্রমণঃ গুজরাট ও মহারাষ্ট্রের নিকটবর্তী দামানের আয়তন ৭২ বর্গ কিমি। ৩৬০ পর্তুগীজ সেনা ও ২০০ পুলিশ দামান রক্ষার দায়িত্ব নিয়োজিত ছিল। ১৮ ডিসেম্বর ভোর ৪টায় ১ ব্যাটালিয়ন ও ৩ রেজিমেন্ট ভারতীয় সেনা দামান আক্রমণ শুরু করে। প্রথম দিকে পর্তুগীজ তীব্র প্রতিরোধ গড়ে তুলে। কিন্তু গোলা-বারুদ শেষ হয়ে যাওয়ায় তারা পিছু হটতে বাধ্য হয়। বিকাল ৫টার মধ্যে বেশির ভাগ এলাকা ভারত দখল নেয়। পর্তুগীজ কামান বাহিনী লক্ষ্য করে সর্বমোট ১৪ বার বিমান হামলা চালায় ভারত। পরদিন ১১টায় প্রায় ৬০০ পর্তুগীজ আত্নসমর্পণ করে। পর্তুগীজ সেকেন্ড লেফটেনেন্ট ব্রিটো পেট্রল বোট নিয়ে ৮৫০ কিমি সমুদ্র পাড়ি দিয়ে করাচি পালিয়ে যান।


   দিউ আক্রমণঃ- ৪০ বর্গ কিমির দিউ গুজরাটের দক্ষিণে অবস্থিত। দিউ সুরক্ষার দায়িত্বে ছিল ৪০০ সেনা ও পুলিশ। ১৮ ডিসেম্বর রাত ১:৩০ মিনিটে ৩ কোম্পানি ভারতীয় সেনা দিউ আক্রমণ করে। কিন্তু পর্তুগীজের তীব্র প্রতিরোধের মুখে বারবার পিছু হটতে বাধ্য হয় ভারতীয় সেনা। সকাল ৭টায় বিমান হামলা শুরু হলে পিছু হটতে বাধ্য হয় পর্তুগীজ। ১০:১৫ মিনিটে ক্রুসার INS Delhi বোমা বর্ষণ শুরু করে। সন্ধ্যা ৬টায় গোয়া বা লিসবন যোগাযোগে ব্যর্থ হয়ে পর্তুগীজ কমান্ডার আত্নসমর্পণের সিদ্ধান্ত নেয়। পরদিন ১২টায় আত্নসমর্পণ করে ৪০৩ পর্তুগীজ। দিউ গভর্ণর বলেন, আরো কয়েক সপ্তাহ আমরা ভারতীয় বাহিনীকে প্রতিরোধ করতে পারতাম। কিন্তু বিমান হামলার কোন উত্তর ছিল না।

  ১৮ ডিসেম্বর রাষ্ট্রসংঘের কাছে যুদ্ধবিরতি প্রস্তাব দেয় যা সোভিয়েত ইউনিয়নের ভেটোর কারণে প্রত্যাখ্যাত হয়। পরদিন রাত ৮:৩০ মিনিটে গভর্ণর জেনারেল ভেসেলো ই সিলভা আত্নসমর্পণ পত্রে স্বাক্ষর করেন। এভাবে গোয়ায় ৪৫১ বছরের পর্তুগীজ শাসনের সমাপ্তি ঘটে।

ক্ষয়ক্ষতিঃ পর্তুগীজের ৩০ সেনা নিহত ও ৫৭ আহত হয়। বিকল হয় ১টি ফ্রিগেট।
২২ ভারতীয় সেনা নিহত ও ৫৪ আহত।

আন্তর্জাতিক প্রতিক্রিয়াঃ-
 
পর্তুগাল> গোয়া পতনের সংবাদ পৌঁছানোর পর লিসবনবাসী শোকাহত হয়ে পড়ে ও ক্রিসমাস উত্সব স্তব্ধ হয়ে যায়।
আমেরিকা> গোয়া থেকে নিঃশর্তভাবে ভারতীয় সেনা সরানোর দাবি জানায়।
 ইসলামিক পাকিস্তান> নগ্ন সামরিক আক্রমণ। ভারতের হৃদয় সহিংস ও আক্রমণাত্নক।
এছাড়াও ব্রাজিল, নেদারল্যান্ড ও ইংল্যান্ড ভারতের বিপক্ষে ছিল।
রাশিয়া, চীন, আরব আমিরশাহি, সিলন ও আফ্রিকান দেশসমূহ ভারতকে সমর্থন দেয়।

No comments:

Post a Comment

loading...
loading...