Thursday 24 August 2017

জোব চার্নকের আগেও কি ছিল কলকাতা শহর ?


 লিখেছেন শৌভিক রাতুল বসুঃ- কলকাতার জন্মদিন ২৪শে আগস্ট ১৬৯০ সাল বলে একটি বহুল প্রচলিত ভুল ধারণা আছে । ১৬৩০ খ্রিস্টাব্দে জোব্ চার্ণক যখন জন্ম নিয়েছেন ব্রিটেনে‚ তখন কলকাতা গোবিন্দপুর সুতানটীর ফিরিঙ্গি দর্শন হয়ে গেছে | আমরা সবাই জানি ব্রিটিশদের আগে এসে বাংলায় বেসাতি এবং বসত দুটোই বসিয়েছিল ওলন্দাজ‚ পর্তুগিজ‚ ফরাসিদের মতো জাতি | তবে কলকাতার থেকেও এদের ঘাঁটি ছিল গঙ্গার ঘাট বরাবর চুঁচুড়া‚ শ্রীরামপুর‚ চন্দরনগরের মতো জায়গা | কিন্তু খাস কলকাতায় ব্রিটিশদের ঢের আগে এসেছিল আর্মেনিয়ানরা |
বড়বাজারের ঘিঞ্জি গলির মধ্যে আছে আর্মেনিয়ান গির্জা | এটা কলকাতার প্রাচীনতম গির্জা | সেই আর্মেনিয়ান হোলি চার্চ অফ নাজারেথ-এ আছে সমাধিক্ষেত্র | কয়েক বছর আগে সংস্করণের সময় সেখানে একটা সমাধি ফলক আবিষ্কৃত হয়েছিল | তাতে লেখা‚ ওই সমাধিতে ঘুমিয়ে আছেন রেজাবীবেহ সুকিয়া ( Rezabeebeh Sookia ) | সমাজে তাঁর স্বামীর পরিচয় "চ্যারিটেবল সুকিয়া" | ১৬৩০ খ্রিস্টাব্দের জুলাইয়ে প্রয়াত হয়েছিলেন রেজাবীবেহ | মৃত্যুর আগে কলকাতায় বাস করছিলেন তিনি |

  এই ১৬৩০ খ্রিস্টাব্দেই জন্ম হয় জোব চার্নকের | ১৬৯০ সনে সাবর্ণ রায়চৌধুরীর পরিবারের সঙ্গে তাঁর সনদ কেনা বেচা | অর্থাৎ তাঁর আগমনের ৬০ বছর আগে এক বিদেশি রমণীর মৃত্যু হয়েছে কলকাতায় | আরও কয়েক বছর ধরে ওই আর্মেনীয় ছিলেন এই শহরেরই বাসিন্দা | এখনও অবধি যা আবিষ্কার হয়েছে তাতে বলা যায় এটাই কলকাতার প্রাচীনতম ক্রিশ্চান সমাধি | কলকাতার রূপকার হিসেবে কিন্তু ব্রিটিশদের নাকে ঝামা ঘষে দিতে পারে আর্মেনীয়ানরা | কিন্তু এশীয়-ইওরোপীয় এই জাতি বণিকের মানদণ্ড নিয়েই সন্তুষ্ট ছিল | রাজদণ্ড ধরতে চায়নি | তাই হয়তো তাদের কৃতিত্ব চাপা পড়ে গেছে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির জাহাজের ভোঁ-য়ের শব্দে |

   ইওরোপ এশিয়া সংযোগস্থলে ককেশীয় পার্বত্য অঞ্চলের দেশ হল আর্মেনিয়া | ষোড়শ শতাব্দী থেকে দেশ ছেড়ে বিশ্বে ছড়িয়ে পড়েন আর্মেনীয়রা | দলে দলে ভাগ হয়ে এগিয়ে যান বিভিন্ন দিকে | তাঁরা ছিলেন সুদক্ষ ব্যবসায়ী | একটি শাখা চলে আসে হিন্দুস্তানে | একমাত্র উদ্দেশ্য ছিল ব্যবসা বাণিজ্য |

  সম্রাট আকবরের সভায় গুরুত্বপূর্ণ স্থানে ছিলেন আর্মেনীয়রা | ১৫৬২ তে তাদের জন্য আগ্রায় গির্জা তৈরি করিয়ে দেন আকবর | পরে জাহাঙ্গীর এবং শাহজাহান এর আমলেও আর্মেনীয় স্বর্ণযুগ চলতে থাকে | দিল্লি থেকে ভারতের অন্যান্য শহরে ছড়িয়ে পড়েছিল এই বেনিয়া জাতি | তারা আমদানি করত পশম‚ অ্যাম্বার‚ কাচ‚ আয়না‚ বন্দুক | বিনিময়ে নিয়ে যেত হিন্দুস্তানি সুতীর পোশাক‚ মশলা‚ দামী পাথর ও মুক্তো |

  চুঁচুড়া হয়ে কলকাতায় এসেছিল আর্মেনীয়রা | খুব সহজেই এই বন্দর শহরের বাণিজ্যের রাশ চলে আসে তাদের মুঠোয়| অষ্টাদশ শতকে তারাই সাহায্য করেছিল ব্রিটিশদের | নতুন শহরে বাণিজ্য করতে | তখন তো আর বোঝেনি খাল কেটে কুমীর আনছে | ১৭১৫ খ্রিস্টাব্দে কলকাতা হয়ে ওঠে আর্মেনীয়দের প্রধান কেন্দ্র |


   ১৬৮৮ খ্রিস্টাব্দে তৈরি হয় কলকাতায় আর্মেনীয়দের প্রথম গির্জা | সম্ভবত ওই স্থান ব্যবহৃত হতো সমাধিক্ষেত্রে হিসেবে | তাই রয়ে গিয়েছিল ১৬৩০ সনের সমাধি | তার পাশেই তৈরি হয় গির্জা | ১৭০৭ খ্রিস্টাব্দে তা বিধ্বংসী আগুনে পুড়ে যায় | ১৭ বছর পরে তৈরি হয় নতুন গির্জা | সেই কাঠামোই এখন দাঁড়িয়ে | বহুবার সংস্কারসাধন হয়েছে| কলকাতায় ছোট ছোট কলোনি করে থাকত আর্মেনীয়রা | প্রথমে উত্তর‚ তারপর মধ্য হয়ে দক্ষিণ কলকাতায় বাসা বানাতে থাকে তারা | ক্রমে স্থানীয় জনজাতির সঙ্গে মিলেমিশে যায় এই বিদেশি সম্প্রদায় | নিজেদের পদবী ছোট করে নেয় | স্মরণীয় হল‚ শেঠ‚ বর্ধন‚ কোচার‚ নারায়ণ‚ নায়ার‚ গওহর এই ভারতীয় পদবীগুলোর উৎস কিন্তু আর্মেনীয়ানরা |

   শুধু ব্যবসা করে মুনাফা লুটে শোষণ করার সম্প্রদায় ছিল না আর্মেনীয়রা | কলকাতাকে সিটি অফ প্যালেস করার পিছনে তাদের অবদান অনস্বীকার্য | পার্ক ম্যানসন‚ কুইন্স ম্যানসন‚ হ্যারিংটন ম্যানসন‚ নিজাম প্যালেস্‚ গ্র্যান্ড হোটেল এবং কলকাতার আরও অনেক অনেক ল্যান্ডমার্ক বিল্ডিং তাদের তৈরি | আরও আছে‚ আর্মানিটোলা‚ আর্মানিঘাট‚ বলতে গেলে শেষ হবে না | রেজাবীবেহ-র স্বামীর নাম দেখুন | পরিচিতি হল ‘চ্যারিটেবল‘ |

    ২০০১ সালে কলকাতা হাইকোর্টে সাবর্ণ রায়চৌধুরী পরিবারদের করা এক রিট পিটিশনের পরিপ্রেক্ষিতে আদালত জানিয়ে দিয়েছিলো যে ১৬৯০ সালের ২৪ শে আগস্ট ( অর্থাৎ চার্ণকের তৃতীয় দফায় সুতানটিতে পদার্পনের দিনটি ) কলকাতার জন্মদিন নয় ; অন্তত তার একশো বছর আগে রচিত আবুল ফজলের লেখা আইন -ই - আকবরী তে কলকাতার স্পষ্ট উল্লেখ আছে । লিখিত ইতিহাস আরো পিছিয়ে বলছে । উইলিয়াম কেরি সাহেবের মতে জন গিলভিয়া নাম এক পর্তুগিজ ১৫১৮ সালে গোবিন্দপুরে এসেছিলেন, গৌরদাস বসাকের তথ্য অনুযায়ী ১৫৩০ সালে সর্বপ্রথম পর্তুগিজ জাহাজ গঙ্গায় এসে গোবিন্দপুরে শেঠ -বসাক দের থেকে বস্ত্রাদি কিনেছিলেন । নগেন্দ্রনাথ শেঠের এর কলকাতাস্থ তন্তুবনিক জাতির ইতিহাস' বলছে কাছাকাছি সময়ে মুকুন্দরাম শেঠ ও কালিদাস বসাকের প্রথমে কালীক্ষেত্র ও পরে গোবিন্দপুরে এসে বসবাস ও ব্যবসাবাণিজ্যের কথা. আর্মেনিয়ান গির্জার উল্লেখ পাওয়া যায় ১৬৩০ সালে ।

  রোটারডাম মিউনিসিপ্যালিটির আর্কাইভসে হুগলি নদীবন্দরের ওপর অনেক তথ্য পাওয়া গিয়েছে । এতে পাওয়া একটি শব্দ বন্ধ হলো 'ব্যাংক জোল' জোল মানে টোল ট্যাক্স । ওলন্দাজরা আদি গঙ্গার পলি কেটে তার নাব্যতা বাড়িয়েছিল; সেই সুবাদে তারা নৌকা বা জাহাজ থেকে টোল সংগ্রহ করতো । এই ব্যাংক জোল থেকেই আজকের ব্যাঙ্কশাল কোর্ট , অর্থাৎ গোবিন্দপুরে. শুধু কি তাই ? নিজেদের খাবার জন্য মাংস যোগান দিতে তারা একটি আস্ত শুয়োরপালন কেন্দ্র খুলে ফেলেছিলো । সেদিনের ওলন্দাজ পিগাড়ি Town হলো আজকের বরাহনগর

  কিন্তু শহরটি তৈরি হয়েছিল তিনটি গ্রাম নিয়ে , তৃতীয় গ্রামটির নাম ছিল ডিহি কলিকাতা. শহরটির নাম কলিকাতা হলো , অথচ কলিকাতা গ্রাম টি উধাও । গ্রামটি গরহাজির নামটি নয় । ১৭০০ সালের মার্চ মাস থেকে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি সুতানুটি ( Chuttanutte ) র বদলে সরকারি চিঠিপত্রে ' ক্যালকাটা' লেখা শুরু করে দিয়েছিলো । হঠাৎ কেন? আইন-ই-আকবরী তে উল্লেখ ছিল বলে? একেবারেই নয় । কারণটা হলো --- ১৬৯৯ সালে ডিহি সুতানুটির খাজনা ছিল ৫০১ টাকা, ডিহি গোবিন্দপুর দিতো ২৩ টাকা, ডিহি কলিকাতা দিতো ৫৬৮ টাকা । যেহেতু কলিকাতা সবচেয়ে বেশি খাজনা দিতো তাই নামকরণ তও করা হয়েছিল সবচেয়ে বেশি রাজস্ব উৎপাদক গ্রামের নামে ।

১৭০৭ সালের কাউন্সিল ডায়রি এন্ড কন্সালটেশন বুক বলছে , কলিকাতার আবাদযোগ্য জমির পরিমান :
ধানক্ষেত্র ৪৮৪ বিঘা ১৭ কাঠা
কলাবাগান ১৬৯ বিঘা ১৮ কাঠা
শাকসবজি ৭৭ বিঘা ১৮ কাঠা
তামাক ৩৮ বিঘা ৭ কাঠা
তুলো ১৯ বিঘা ১৫ কাঠা
বাগান ৭০ বিঘা ৯ কাঠা
ঘাস ১৫ বিঘা ১ কাঠা
বাঁশবাগান ১ বিঘা ১৬ কাঠা
ফুল ৬ বিঘা ২ কাঠা
আউশক্ষেত্র ১১ বিঘা ৯ কাঠা

No comments:

Post a Comment

loading...
loading...